শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া(Curriculum revision and development process)
শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও উন্নয়ন করার বহুল প্রচলিত ধাপ রয়েছে। এনসিটিবি শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও উন্নয়ন করার ক্ষেত্রে এই ধাপগুলো অনুসরণ করে থাকে । ধাপসমূহ হলো : ধাপ ১- গবেষণা, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং চাহিদা নিরুপণ শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে প্রচলিত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য বিস্তৃত পরিসরে গবেষণা পরিচালনা করা হয়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা শিক্ষায় প্রচলিত শিক্ষাক্রমের কার্যকারিতা, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং শিখন চাহিদা নিরূপনের উদ্দেশ্যে ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল ব্যাপী বিস্তৃত পরিসরে চারটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়। গবেষণার পাশাপাশি শিক্ষার বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও চাহিদা নিরূপণের জন্য বিভিন্ন কারিগরি কর্মশালা, ইস্যুভিত্তিক আলোচনা ইত্যাদি পরিচালিত হয়। উক্ত গবেষণাসমূহে সরকারের লক্ষ্য, পরিকল্পনা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার পর্যালোচনা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা, বিভিন্ন দেশের শিক্ষাক্রম, তথ্য ও দলিল ইত্যাদি পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়। এসকল গবেষণার সুপারিশসমূহ বিবেচনা করে কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাক্রম কেমন হবে তা নির্ধারণ করা হয় । ধাপ ২- জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা উন্নয়ন প্রচলিত প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমের ভিত্তি, গঠন ও প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন। উল্লিখিত গবেষণাসমূহে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাক্রমের ভিন্ন ভিন্ন অ্যাপ্রোচের পরিবর্তে একই অ্যাপ্রোচে শিক্ষাক্রম প্রণয়নের অপরিহার্যতার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এ ক্ষেত্রে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের সাম্প্রতিক ধারণা বিবেচনায় নিয়ে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। এমতাবস্থায় শিক্ষার বিভিন্ন স্তর ও পর্যায়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত একটি নিরবিচ্ছিন্ন (seamless) শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করার উদ্দেশ্যে একটি জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখার পরিকল্পনা করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক এই জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়নের কাজটি সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটি (Curriculum Development and Revision Core Committee- CDRCC) গঠন করা হয়। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বিষয় বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে এই কমিটি গঠন করা হয় । পরবর্তী সময়ে সিডিআরসিসির পরামর্শক্রমে শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, এনসিটিবির কর্মকর্তা এবং বিষয় বিশেষজ্ঞগণের সমন্বয়ে একটি কার্যসম্পাদন কমিটি (Working Committee) গঠন করা হয়। এই কমিটি জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা উন্নয়নে কারিগরি ও নিয়মতান্ত্রিক কাজসমূহ সম্পাদনসহ সিডিআরসিসিকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করে। কার্যসম্পাদন কমিটি একাধিক কর্মশালা ও সভার মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখার উপর একটি ধারণা প্রণয়ন করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ও উপমন্ত্রী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীসহ দুই মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণের উপস্থিতিতে আয়োজিত সভায় উক্ত ধারণা অনুযায়ী প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত একটি সিমলেস বা নিরবিচ্ছিন্ন শিক্ষাক্রম উন্নয়নের উদ্দেশ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা উন্নয়নের নির্দেশনা প্রদান করা হয়। তদানুযায়ী সিডিআরসিসির তত্ত্বাবধানে কার্যসম্পাদন কমিটি বিষয় বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, শ্রেণি শিক্ষক, শিখন বিশেষজ্ঞগণকে নিয়ে একাধিক কর্মশালা ও কারিগরি সভার মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা প্রণয়নের কাজ শুরু করে। সিডিআরসিসি ও কার্যসম্পাদন কমিটির মাধ্যমে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়গণের প্রত্যক্ষ নিদের্শনায় ও অন্যান্য নীতি নির্ধারকদের পরামর্শে ১৫টির বেশি কারিগরি কর্মশালা ও শতাধিক ভার্চুয়াল সভার মাধ্যমে ৩৩টি সংস্থার ১৫৬ জন বিশেষজ্ঞের সরাসরি অংশগ্রহণে এ শিক্ষাক্রম রূপরেখার প্রথম খসড়া প্রণয়ন করা হয় । গবেষণার মাধ্যমে প্রচলিত শিক্ষাক্রম এর পরিস্থিতি বিশ্লেষণ কার্যকারিতা যাচাই এবং চাহিদা নিরূপণ (২০১৭-২০১৯) থিমেটিক কর্মশালা ও সভার মাধ্যমে জাতীয় সমন্বিত স্কিল ফ্রেমওয়ার্ক উন্নয়ন (২০১৮-২০১৯) প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাক্রম রূপরেখার ধারণা উন্নয়ন (২০১৯) শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটি (CDRCC) গঠন ( ২০২০ ) (CDRCC)-কে সহায়তা করার জন্য কার্যসম্পাদন কমিটি গঠন কার্যসম্পাদন কমিটির সহায়তায় সংশ্লিষ্ট বিষয় বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাক্রম রূপরেখার খসড়া প্রণয়ন (২020) মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর এবং বোর্ডের সাথে মতবিনিময় ( ২০২০ ) খসড়া রূপরেখার উপর ৮০০ জনের অধিক অংশীজনের মতামত গ্রহণ অংশীজনের মতামত বিশ্লেষণ এবং তদানুযায়ী খসড়া হালনাগাদকরণ শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটি কর্তৃক হালনাগাদকৃত খসড়া অনুমোদন বিভিন্ন পর্যায়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণের সাথে একাধিক সভায় খসড়া সম্পর্কে মতামত গ্রহণ সর্বসাধারণের মতামত গ্রহণের উদ্দেশ্যে ওয়েবসাইটে উন্মুক্তকরণ প্রাপ্ত মতামত পর্যালোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত খসড়া উন্নয়ন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক চূড়ান্ত খসড়া NCCC-তে প্রেরণের জন্য অনুমোদন প্রদান মন্ত্রণালয় কর্তৃক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনার জন্য প্রেরণ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নীতিগত অনুমোদন পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাইয়ের জন্য উপদেষ্টা কমিটিতে প্রেরণ এবং কমিটির মতামতের প্রেক্ষিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ এর খসড়া চূড়ান্তকরণ NCCC কর্তৃক চূড়ান্ত অনুমোদন এই ধারাবাহিকতায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বিশেষজ্ঞগণের সরাসরি পরিচালনায় ১৩টি দলের মাধ্যমে খসড়া শিক্ষাক্রম রূপরেখার উপর ৮০০-এর অধিক অংশীজনের মতামত গ্রহণ করা হয়। অংশীজনদের মধ্যে রয়েছেন নীতি নির্ধারক (মাননীয় মন্ত্রীমহোদয়গণ, মাননীয় সংসদ সদস্যগণ, সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ); প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ; শিক্ষা সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা (বেসরকারি উদ্যোক্তা); শিক্ষা বিশেষজ্ঞ (বিজ্ঞান শিক্ষা, গণিত শিক্ষা, সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষা, ভাষা শিক্ষা, বিশেষ শিক্ষা, ব্যবসায় শিক্ষা, একীভূত শিক্ষা), শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ, শিক্ষা প্রশাসক, শিক্ষক প্রশিক্ষক (নায়েম, নেপ, এইচএসটিটিআই, পিটিআই, টিটিসি, টিটিটিসি, বিএমটিটিআই); অভিভাবক (প্রাথমিক, মাধ্যমিক, বৃত্তিমূলক); শিক্ষক (প্ৰাথমিক, মাধ্যমিক, বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা, শিক্ষা); শিক্ষার্থী (প্রাথমিক, মাধ্যমিক, বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা, শিক্ষা); বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক (বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা, কারিগরি, মেডিকেল, প্রকৌশল, কৃ ষি, পরিবেশ, সামাজিক বিজ্ঞান); পেশাজীবী (প্রযুক্তিবিদ, ডাক্তার, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, কৃষিবিদ, পরিবেশবিদ, উন্নয়ন কর্মী); নিয়োগকর্তা (ইন্ডাস্ট্রি, পিএসসি, এনজিও, উদ্যোক্তা, মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন সেক্টর – আইসিটি, কৃষি, গার্মেন্টস, গণমাধ্যম, সৃজনশীল মিডিয়া); মাদ্রাসা (শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ); কারিগরি (শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ); এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন সদস্য। অংশীজন পরামর্শের মাধ্যমে প্রাপ্ত সুনির্দিষ্ট মতামতগুলোর যথাযথ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে পরবর্তীকালে খসড়া শিক্ষাক্রম রূপরেখাটি পরিমার্জন করা হয়। এ পর্যায়ে খসড়া জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখাটি ১৩.০১.২০২০ তারিখে সিডিআরসিসি সভায় উপস্থাপন করা হয় যা কমিটি কর্তৃক পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য অনুমোদন করা হয় । সিডিআরসিসি’র সুপারিশ অনুযায়ী সর্বসাধারণের মতামতের উদ্দেশ্যে খসড়া রূপরেখাটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত করা হয়। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রাপ্ত সুপারিশ খসড়া রূপরেখাকে আরও সমৃদ্ধ করে । ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে অনুষ্ঠিত এনসিটিবির ৬৮৪ তম জরুরি বোর্ড সভার ০১ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খসড়া জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখাটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির নিকট প্রেরণ করা হয়। এমতাবস্থায়, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখার গুরুত্ব উপলব্ধি করে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখার উপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় নির্দেশনা কামনা করেন। তদানুযায়ী জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখার একটি সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয় । ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে একটি ভার্চুয়াল সভার মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা উপস্থাপনা করা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা প্রদান করেন এবং উপস্থাপিত জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখার বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এই সভার মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নীতিগত অনুমোদন লাভ করে। ১২ অক্টোবর ২০২১ তারিখে জাতীয় শিক্ষাক্রম সম্পর্কিত উপদেষ্টা কমিটির সভায় জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখাটি উপস্থাপন করা হলে