মাদ্রাসা শিক্ষা এই উপমহাদেশের প্রাচীনতম একটি ধারা। আমাদের দেশে এটি তার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি স্বতন্ত্রধারা হিসেবে প্রচলিত। মাদ্রাসা শিক্ষার বিশেষত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখার মূলভিত্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখেই মাদ্রাসা শিক্ষাধারা সাজানো হয়েছে। সেই লক্ষ্যে মাদ্রাসা শিক্ষাধারার ক্ষেত্রে বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোই এই অধ্যায়ে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, সাধারণ শিক্ষাধারার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ দিকগুলোও মাদ্রাসার শিক্ষাক্রম উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখা হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও উন্নয়নের ভিত্তি দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবী এবং বিশ্বায়নের যুগে সুযোগ এবং সম্ভাবনার যেমন সাধারণীকরণ হয়েছে, তেমনি সকলের সামনের চ্যালেঞ্জ ও বাধাগুলোর ধরনও এক। ন্যূনতম অবশ্য অর্জনীয় দক্ষতাসমূহ না থাকলে সেসব চ্যালেঞ্জ ও বাধা মোকাবিলা করা প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া পরিবর্তনের বহুমাত্রিকতার কারণেও প্রতিনিয়ত খাপ খাইয়ে চলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সকল ধারার শিক্ষার্থীদেরই ন্যূনতম সাধারণ (Common) কিছু যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। ফলে বিভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনা সাপেক্ষে বৈষম্য কমিয়ে এনে কতকগুলো অর্জনযোগ্য মূল যোগ্যতা সকলের জন্য নির্বাচন করা প্রয়োজন। এটি বিভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থাকে সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে একটি কাঠামোতে আনতে সহায়তা দিয়ে থাকে । যে কোনো উদ্যোগ তার পূর্ববর্তী প্রেক্ষাপটকে স্মরণ করে অগ্রবর্তী হয়। মাদ্রাসা ধারার শিক্ষাব্যবস্থাও তার ব্যতিক্রম নয়। এর একটি সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যপূর্ণ গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। মাদ্রাসা মুসলিম উম্মার বুনিয়াদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যুগ যুগ ধরে পরিগণিত হয়ে আসছে। এর কারণ হলো, ইহলৌকিক এবং পারলৌকিক সফলতার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা সর্বদা সচেষ্ট ছিল। বস্তুতঃ ইসলাম ধর্মের উন্মেষ কালেই মাদ্রাসা শিক্ষার সূচনা ঘটে । হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) (uads lb (do ৩) হিজরতের পূর্বে মক্কার অদূরে অবস্থিত সাফা পাহাড়ের পাদদেশে ‘দারুল আরকাম’ এবং হিজরতের পর মসজিদে নববীর উত্তর-পূর্ব দিকে ‘সুফফা আবাসিক মাদ্রাসা’ ও ‘দারুল কুররা মাদ্রাসা’ স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে হযরত ওমর (রা.) সিরিয়ায় ও হযরত আলী (রা.) বসরা ও কুফায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। খোলাফায়ে রাশেদার সময়ে ইসলামী সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ৪০টিরও অধিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলাম ধর্মের প্রসারের ধারাবাহিকতায় ৭১২ সালে মুহাম্মদ বিন কাসেমের সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে উপমহাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার বিস্তার ঘটে। ১২০৪ সালে মুসলমানদের বঙ্গ বিজয় ও শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে বাংলায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়। সুলতানী শাসনামলে (১২১০-১৫৭৬ খ্রিঃ) বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্যসূচিতে কুরআন, হাদিস, ফিকহ, আরবি, নাহু, সরফ, বালাগাত, মানতিক, কালাম, তাসাউফ, হিকমত ও দর্শন অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তীকালে মাদ্রাসা শিক্ষাক্রম বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পরিমার্জিত ও আধুনিকীকরণ হয়। বিশেষভাবে মুঘল আমলে মাদ্রাসা শিক্ষাক্রমে ইসলামি বিভিন্ন বিষয়াদির সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা পর্যায়ক্রমে যুক্ত হয়। এগুলোর মধ্যে চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, ভূগোল, হিসাববিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান, লোক প্রশাসন, জীববিদ্যা, পদার্থ, রসায়ন ও প্রাণিবিদ্যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভারত উপমহাদেশের উলামায়ে কেরাম ও সাধারণ মুসলমানদের সম্মিলিত দাবীর প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ শাসনের প্রথমদিকে দীর্ঘকাল সরকারি কাজে, বিশেষ করে দলিল-দস্তাবেজ ও আদালতের ভাষা ফার্সি থাকায় মাদ্রাসা শিক্ষা প্রায়োগিক গুরুত্ব লাভ করে। সে সময় মোল্লা মাজদুদ্দীন (মোল্লা মা’দান) রহ. এর নেতৃত্বে ‘কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে তা ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদন লাভ করে । পরবর্তী কালে বাংলার বিভিন্ন স্থানে ‘কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা’র অনুসরণে নতুন নতুন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, কলকাতা মাদ্রাসা ধারার বাইরেও বাংলায় বিভিন্ন ধারার মাদ্রাসা চালু ছিল। ব্রিটিশ সরকারের ১৯০৬ সালে গঠিত ‘মাদ্রাসা রিফোর্স কমিটি’ কর্তৃক ১৯১৪ সালে ‘রিফোর্সড মাদ্রাসা স্কীম’ নামে মাদ্রাসা শিক্ষাক্রমকে আধুনিকায়ন করার চেষ্টা করে এবং তা ফলপ্রসূ হয়। এখানে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাকে আবশ্যিক করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিলো মক্তব এবং মাদ্রাসাগুলোকে আধুনিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মতো উন্নত মাত্রায় নিয়ে যাওয়া। এপ্রিল ১৯১৫ তে এটি কার্যকর হয়। মাদ্রাসা শিক্ষাক্রমের এই পরিমার্জন অধিকাংশরাই মেনে নিয়েছিলেন – যা ‘নিউ স্কীম’ নামে পরিচিত। অল্প কিছু সংখ্যক মাদ্রাসা তাদের পুরনো ধারাতেই আবদ্ধ ছিল। এ সকল মাদ্রাসার মধ্যে অন্যতম কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা যা ওল্ড স্কীমের আওতাভুক্ত ছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০শে মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকার মাঠে ভাষণে প্রদত্ত নির্দেশনার মাধমে মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে নতুনভাবে গতি সঞ্চার হয় । ১৯৮৪ সালে ‘মুস্তফা বিন কাসিম কমিটি’র সুপারিশের আলোকে বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষা স্তরের সাথে সামঞ্জস্য বিধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাকে কয়েকটি স্তরে বিভক্ত করা হয়। এভাবে বর্তমানে বাংলাদেশে সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে সামঞ্জস্য গড়ে উঠেছে। ফলে বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষার সমমান পাচ্ছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার জন্য কিছু সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেছে। ইসলাম শিক্ষার সুযোগ তৈরির পাশাপাশি জীবনধারণ-সংক্রান্ত শিক্ষা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী হয়ে শিক্ষার্থীরা যেন উৎকর্ষে ভূমিকা রাখতে পারে সে ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মাদ্রাসা শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের পূর্ববর্তী সকল গবেষণা থেকে শিক্ষার্থীর উৎকর্ষ সাধনকল্পে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা পাওয়া গিয়েছে যা সাধারণ শিক্ষাধারার সাথে মাদ্রাসার শিক্ষাধারার সমন্বয়কে অনুপ্রাণিত করে। জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ২০১১ সালে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। ২০১৫ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২.১৯.২ বিশেষায়িত ধর্মীয় শিক্ষাধারা হিসেবে রূপরেখায় উল্লিখিত রূপকল্প অর্জনের পাশাপাশি ইসলামি মূল্যবোধে সমৃদ্ধ তাকওয়াবান যোগ্য আলিম তৈরি করাও মাদ্রাসা শিক্ষাধারার অন্যতম উদ্দেশ্য। ২.১৯.৩ মাদ্রাসা শিক্ষাধারার ক্ষেত্রে শিক্ষাক্রমের রূপকল্প বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত অভিলক্ষ্যসমূহের সাথে মাদ্রাসাকে ইসলামি আকিদা, আমল, আখলাক ও ইলম চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। ২.১৯.৪ মাদ্রাসা শিক্ষাধারায় শিক্ষার্থীকে বিশ্বপরিস্থিতিতে টিকে থাকার মতো যোগ্য, তাকওয়াবান ও আধুনিক মানসিকতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে এবতেদায়ী থেকে আলিম শ্রেণি পর্যন্ত একটি অবিচ্ছিন্ন শিক্ষাক্রম উন্নয়নের উদ্যোগ জরুরি। এবতেদায়ী ও দাখিল-আলিম পর্যায়ের শিক্ষা সম্পন্ন করে একজন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণ করবে বা কর্মজীবনে প্রবেশ করবে। ২.১৯.৫ শিক্ষাক্রম রূপরেখায় বর্ণিত সংহতি, দেশপ্রেম, সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধা/সম্মান ও শুদ্ধাচার এই মূল্যবোধগুলোর পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষাধারার ক্ষেত্রে ইসলামি মূল্যবোধকে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই শিক্ষাধারা ইমান, আকিদা, আমল এবং আখলাক এর মধ্য দিয়ে ইসলামি মূল্যবোধকে ধারণ করে। ২.১৯.৬ শিক্ষাক্রম রূপরেখায় উল্লিখিত শিক্ষার্থীর কাক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মাদ্রাসা শিক্ষাধারায় যুক্ত হবে তাকওয়া। তাকওয়া বলতে আল্লাহর ভয় ও পরকালীন জবাবদিহিতাকে সামনে রেখে সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ জীবন যাপনকে বুঝানো হয়। ফলে একজন শিক্ষার্থী নিজ সম্প্রদায়সহ অন্যান্য সকল সম্প্রদায়ের মানুষের বিশ্বাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতি সম্প্রীতি সংস্থাপন করতে উদ্যোগী হয়ে উঠবে। ২.১৯.৭ শিক্ষাক্রম রূপরেখায় শিক্ষার্থীর যেসব দক্ষতা নির্ধারণ করা হয়েছে তা মাদ্রাসা শিক্ষাধারায় সমভাবে প্রযোজ্য। ২.১৯.৮ মাদ্রাসা শিক্ষাধারায় যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা এবতেদায়ি থেকে আলিম স্তর পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষাক্রমে বর্ণিত দশটি মূল যোগ্যতা অর্জন করবে। স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য এই শিক্ষাধারা জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখায় বর্ণিত ‘ধর্মীয় অনুশাসন, সততা ও নৈতিক গুণাবলী অর্জন এবং শুদ্ধাচার অনুশীলনের মাধ্যমে প্রকৃতি ও মানব-কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারবে ’- যোগ্যতাটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ইসলাম শিক্ষা শিখনক্ষেত্র হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। ইসলাম শিক্ষা শিখনক্ষেত্র অনুযায়ী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্বতা ও সৃষ্টিকর্তা সম্বন্ধে সঠিক উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। যেমন : স্রষ্টা ব্যতীত সৃষ্টির অস্তিত্ব কল্পনাতীত হওয়ার উপলব্ধি। সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে কুরআন, সুন্নাহ ও