বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতার বিবরণী
পরিবর্তনশীল কর্মজাত, কর্মের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে সকল কাজের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়ন করা, কর্মজগতে প্রবেশের প্রস্তুতি হিসেবে দৈনন্দিন কাজ অনুশীলনের মাধ্যমে প্রাক-যোগ্যতা, কর্মজগতের উপযোগী প্রায়োগিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করা, কর্মজগতে ঝুঁকিমুক্ত ও সুরক্ষিত থেকে ভবিষ্যৎ দক্ষতায় অভিযোজন করতে পারা এবং সকলের জন্য নিরাপদ ও আনন্দময় কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে অবদান রাখতে পারা।
বিষয়ের ধারণায়ন
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রযাত্রার ফলে এই শতাব্দীর শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়তই একটি পরিবর্তনশীল বিশ্বের সম্মুখীন হচ্ছে। পরিবর্তনশীল এই বিশ্বে জীবিকা বদলে যাচ্ছে, নিত্য নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। বর্তমান বিশ্ব চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছে। পূর্বে মেশিন লার্নিং, রোবোটিক্স, বিগডাটা, কৃ ত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো টেকনোলোজি, থ্রি-ডাইমেনশন প্রিন্টার, জেনেটিক্সসহ একুশ শতকের আরো অনেক প্রযুক্তি আলাদাভাবে বিকশিত হতে থাকলেও বর্তমানে এই প্রযুক্তিসমূহ পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে এমনভাবে দ্রুত গতিতে বিকশিত হচ্ছে যা পুরো বিশ্ব ব্যবস্থাকেই নতুন করে বিন্যস্ত করছে। এ কারণে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এবং ভবিষ্যতের শিল্পবিপ্লবের ধাক্কায় বদলে যাওয়া কর্মজ্ঞাতে আগামী প্রজন্মের টিকে থাকা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় জীবন দক্ষতা ও কর্মযোগ্যতা তৈরি করা জরুরি। একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে- যে শিশুরা আজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়, তাদের ৬৫% কর্ম জগতে প্রবেশ করবে এমন একটি কাজ বা চাকুরি নিয়ে, যে কাজের বা চাকুরির কোনো অস্তিত্বই বর্তমানে নেই” । এরকম দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং অজানা বিশ্বকে বিবেচনা করে, আজকের শিক্ষার্থীদের, তাদের কর্মজগতে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের নিমিত্তে ‘জীবন ও জীবিকা’ বিষয়টির নকশা প্রণয়ন করা হয়।
ব্যানবেইস ২০১৯ রিপোর্ট অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের পূর্বে প্রায় ১৮% শিক্ষার্থী, দশম শ্রেণি সমাপ্তের আগে মাধ্যমিক শিক্ষাথীর প্রায় ৩৮% এবং দ্বাদশ শ্রেণি সম্পূর্ণ করার পূর্বেই উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীর প্রায় ২০% শিক্ষার্থী শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়ে। অর্থাৎ গড়ে প্রায় ৭০% শিক্ষার্থী দ্বাদশ শ্রেণি সম্পূর্ণ করার পূর্বেই বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে এবং কোনোরকম পেশাগত প্রশিক্ষণ বা দক্ষতা ছাড়াই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। আবার উচ্চ মাধ্যমিক বা স্নাতক সমাপ্তির পরও অনেক সংখ্যক শিক্ষার্থী বেকার থাকে। এর পেছনে কারণ হিসেবে দেখা গেছে কর্মজগতের চাহিদা অনুযায়ী সাধারণ শিক্ষার শিক্ষার্থীদের দক্ষতার ঘাটতি। তাই সাধারণ শিক্ষাধারার সকল শিক্ষার্থীই মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক শেষে যেন পেশাগত দক্ষতা অর্জন করে শ্রমবাজারে সরাসরি যুক্ত হতে পারে এই লক্ষ্যে সাধারণ শিক্ষাধারায় ‘জীবন ও জীবিকা’ নামে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
জীবন ও জীবিকা বিষয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যত কর্মজগতে প্রবেশের জন্য নিজেকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে পরিবর্তনশীল শ্রমবাজার বিবেচনায় নিয়ে সঠিকভাবে ক্যারিয়ার প্ল্যানিং করতে পারবে। সে লক্ষ্য বা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পদ্ধতিগতভাবে বিভিন্ন বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। পেশাগত দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি একুশ শতকের উপযোগী প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করবে। কর্মজাতে প্রবেশের জন্য রূপান্তরযোগ্য দক্ষতা (ট্রান্সফারেবল স্কিল) ও বৃত্তিমূলক (অকুপেশনাল) দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি নিজ, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের কাছে তার দায়বদ্ধতা উপলব্ধি করে তার উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য সচেষ্ট হবে।
এই বিষয়টি শিক্ষার্থীদের কর্মের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব তৈরি এবং প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন কাজ করার সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসী ও স্বনির্ভর হয়ে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে। জীবন ও জীবিকা বিষয় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও প্রবণতা অনুযায়ী ভবিষ্যৎ দক্ষতা অর্জনে সক্ষম করে তুলবে এবং তা কাজে লাগিয়ে আগামীতে শিক্ষার্থীরা তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে উদ্ভূত ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে যে কোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারবে।
উক্ত যোগ্যতা অর্জনের জন্য চারটি ডাইমেনশন নির্ধারন করা হয় :
আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মউন্নয়ন : ভবিষ্যত বিশ্বের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে নিজেকে জানা সবচেয়ে আগে প্রয়োজন। নিজেকে জানার মাধ্যমে একদিকে যেমন নিজের পছন্দ-অপছন্দ, ভালোলাগা-মন্দলাগা সম্পর্কে নিজে জানবে সেই সাথে নিজের শক্তি ও সামর্থ্য সম্পর্কে এবং নিজের দুর্বলতা ও নিজের উন্নয়নের ক্ষেত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জনের মাধ্যমে নিজের উত্তরোত্তর উন্নয়নের জন্য প্রচেষ্টা বহাল রাখতে পারবে। মানুষ সেই পেশায় সবচেয়ে ভালো করে যে পেশায় কাজ করতে সে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। তখন কাজকে সে
আরো বেশি উপভোগ করতে পারে । এজন্য আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মউন্নয়নকে একটি ডাইমেনশন হিসেবে এখানে ধরা হয়েছে। একই সাথে ইতিবাচক আত্মসম্মানবোধের উন্মেষ ঘটানোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজ, পরিবার, সমাজ ও জাতীয় দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হবে; নিজের কাজ, পরিবারের কাজ, বিদ্যালয়ের দায়িত্ব, সামাজিক ও জাতীয় দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ হতে পারবে।
ক্যারিয়ার প্ল্যানিং (কর্মজীবন পরিকল্পনা) : নিজেকে সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ক্যারিয়ার প্ল্যানিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে সিস্টেমেটিক উপায়ে শিক্ষার্থী নিজের পছন্দ ও সামর্থ্য বিবেচনা করে ভবিষ্যত পেশা নির্বাচন করতে পারে এবং সেই অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করতে পারে। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তাকে নিজের আগ্রহ, ঝোঁক, দক্ষতা বিবেচনা করে, পরিবর্তশীল বিশ্বে শ্রমবাজারের ওপর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব এবং পারিবারিক সক্ষমতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে একটি কার্যকর কর্মজীবন পরিকল্পনা করতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনশীল বিশ্ব ও অজানা ভবিষ্যত বিবেচনা করে পরিকল্পনা এমনভাবে করতে হবে যাতে যেকোনো পরিস্থিতিতে তা পরিমার্জন বা পরিবর্তন বা সময়ের সাথে সাথে সমন্বয় করা যায়।
পেশাগত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা : শিক্ষার্থীরা যাতে পড়াশোনার পাশাপাশি এমন একটি দক্ষতা অর্জন করতে পারে যাতে শিক্ষা সমাপান্তে কর্মক্ষেত্রের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারে অথবা কোনো একটি নির্দিষ্ট পেশায় দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান করতে পারে। কারিগরি শিক্ষার সংগে সমন্বয় করে যেকোনো একটি বৃত্তিমূলক (অকুপেশনাল) বিষয়ের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে তা সম্পন্ন করা হবে।
ভবিষ্যৎ কর্মদক্ষতা : বিশ্বায়ন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, ডেমোগ্রাফিক রূপান্তরের ধারার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি মূহুর্তে বৈশ্বিক পরিবর্তনের চলমান প্রক্রিয়ায় নতুন নতুন পেশার সৃষ্টি হচ্ছে এবং অনেক পুরোনো পেশার সমাপ্তি ঘটছে। ভবিষ্যৎ নতুন পেশার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ রাখতে ভবিষ্যৎ কর্মদক্ষতা একটি ডাইমেনশন হিসেবে রাখা হয়েছে। অজানা পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে নিজেকে হালনাগাদ রাখা ও জীবনব্যাপী শিখনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। নতুন পেশার জন্য আবশ্যিক সুনির্দিষ্ট দক্ষতাসমূহ সম্পর্কে যেহেতু আমরা জানিনা তাই একুশ শতকের দক্ষতাসমূহ বিশেষত সূক্ষ্ম চিন্তন দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, কোলাবোরেশন বা দলে কাজ করার দক্ষতা, সৃজনশীল দক্ষতা ও যোগাযোগ দক্ষতাসমূহ অর্জনের সুযোগ থাকবে।
প্রতিটি ডাইমেনশনে দক্ষতা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়ন এবং নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এই বিষয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর জ্ঞান ও অনুধাবনের পাশাপাশি দৈনন্দিন কর্ম অনুশীলন করে ব্যবহারিক কাজের দক্ষতা অর্জন করতে পারবে এবং জীবনঘনিষ্ট কর্মকান্ডের মাধ্যমে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ অর্জন করবে। বিষয়টির পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে প্রতিটি শিক্ষার্থীই কোনো একটি পেশাগত দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাও অর্জন করতে পারে। স্থানীয় চাহিদা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী বিদ্যালয় বা শিক্ষার্থীর নিজ এলাকায় উপার্জন সংশ্লিষ্ট কাজে অংশগ্রহণ করার অভিজ্ঞতা অর্জনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা উদ্যোক্তা হিসেবে বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। জীবন ও জীবিকা বিষয়ের মাধ্যমে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপান্তে শিক্ষার্থীরা পরবর্তী উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে পারবে, বৃত্তিমূলক (অকুপেশনাল) কোর্স সংশ্লিষ্ট কোনো একটি পেশার প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করে সরাসরি কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারবে অথবা উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারবে।
প্রাথমিক স্তরে জীবন ও জীবিকা কোনো আলাদা বিষয় নয় কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বিষয়ের যোগ্যতার বুনিয়াদ প্রাথমিক স্তর থেকেই নির্মিত হতে থাকবে। প্রাথমিক স্তরে জীবন ও জীবিকা বিষয় ক্রস-কাটিং হিসেবে ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ ও ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বিষয়ের সাথে যৌক্তিকভাবে সন্নিবেশ করা হবে যার প্রতিফলন অন্যান্য বিষয়েও থাকতে পারে ।
===000===
তথ্যসূত্র : শিক্ষাক্রম রুপরেখা-2021