একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম নাগরিক সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশই যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম অনুসরণ করছে। বাংলাদেশেও শিক্ষাক্রম রূপরেখাটি যোগ্যতার ধারণাকে কেন্দ্র করেই উন্নয়ন করা হয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায়, জ্ঞান, দক্ষতা এবং ইতিবাচক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি সমন্বিতভাবে অর্জিত হলে শিক্ষার্থীর মাঝে যোগ্যতা গড়ে উঠে। উদাহরণস্বরূপ, একটি গাড়ি কীভাবে চালনা করতে হয় তা যখন বই পড়ে বা শুনে বা দেখে একজন শিক্ষার্থী জানতে পারে, তার জ্ঞান অর্জিত হয়। ঐ শিক্ষার্থী যদি গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশগুলো হাতে-কলমে পরিচালনা করতে শেখে অর্থাৎ গাড়ি সামনে, পেছনে, ডানে বা বামে চালাতে পারে কিংবা ব্রেক করতে পারে, তবে তার দক্ষতা তৈরি হয়। আর যদি সে গাড়ি চালিয়ে নিজের ও রাস্তার সকল মানুষ, প্রাণী ও সম্পদের নিরাপত্তা রক্ষা করে গন্তব্যে পৌঁছানোর সক্ষমতা অর্জন করে, তবে ঐ শিক্ষার্থীর গাড়ি চালনা বিষয়ে যোগ্যতা অর্জিত হয়। এখানে জ্ঞান, দক্ষতা এবং মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি সমন্বিতভাবে কাজ করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের ধারণা জনপ্রিয়তা পেলেও ‘যোগ্যতা’র সুনির্দিষ্ট বা একক কোনো তত্ত্ব বা সংজ্ঞার্থ গড়ে ওঠেনি যার মাধ্যমে প্রচলিত সকল ধারণাকে একটি অভিন্ন ফ্রেমে বাঁধা যায় (Winterton et al., 2005)। প্রেক্ষাপট যোগ্যতার ধারণাকে প্রভাবিত করে বলেই বিভিন্ন দেশের যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমে যোগ্যতাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আবার শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে, কিংবা বিভিন্ন পেশাগত ক্ষেত্রে যোগ্যতা সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা ব্যবহার করা হয়েছে (Kennedy D & Hyland A, 2009)। এমনকি নাম ব্যবহারের ক্ষেত্রেও রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্র্য, কেননা কোনো শিক্ষাবিদ বা গবেষক ‘যোগ্যতা’ বোঝাতে ব্যবহার করেছেন সক্ষমতা, আবার অনেকেই ব্যবহার করেছেন দক্ষতা বা Capacity, Capability, Performance Standard ইত্যাদি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যোগ্যতাকে খুবই সংকীর্ণ অর্থে, অর্থাৎ, যোগ্যতা আর দক্ষতাকে প্রায় সমার্থক করে দেখা হয়েছে। (Adam 2004, Brown and Knight 1995)। অন্যদিকে ECTS (Europian Credit Transfer System) Users’ Guide 2009 সংজ্ঞা অনুযায়ী ব্যক্তিগত এবং পেশাগত উন্নয়নের প্রয়োজনে শিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে জ্ঞান, দক্ষতা এবং ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পদ্ধতিগত সক্ষমতা প্রয়োগের প্রমাণিত ক্ষমতাই যোগ্যতা। নার্সিং পেশায় সেবা দেয়ার সময় জ্ঞানমূলক, আবেগীয় ও মনোপেশিজ দক্ষতাসমূহ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারাই যোগ্যতার পরিচায়ক (Miller et al, 1988) । পেশাগত ক্ষেত্রে যোগ্যতা হলো জ্ঞান, মনোভাব এবং আচরণের এমন এক প্যাটার্ন যা একত্রে কোনো কাজ সম্পাদনের সামর্থ্য তৈরি করে (Neary, 2002)। শুধু জ্ঞান আর দক্ষতা নয় বরং মূল্যবোধ, সূক্ষ্ম চিন্তন, পেশাগত বিচার-বিবেচনা, মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজ ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্বের সন্নিবেশনও অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যতার অন্তর্ভুক্ত।
একইভাবে দেশভেদেও যোগ্যতার ধারণায় পার্থক্য দেখা যায়। The Higher Education and Training Awards Council of Ireland (HETAC)-এর মতে, বিভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতিতে জ্ঞান ও দক্ষতার সৃজনশীল ও কার্যকর প্রদর্শন এবং প্রয়োগ করতে পারাকেই যোগ্যতা বলে। এ কাউন্সিল আরো মনে করে যে, শিক্ষার্থীর নিজের দুর্বলতা নিজেই চিহ্নিত করতে পারা এবং সে অনুযায়ী নতুন কিছু শিখতে পারাও যোগ্যতা। ২০০০ সালে Tuning Educational Structures in Europe নামক প্রকল্প ইউরোপের শিক্ষার ক্ষেত্রে যোগ্যতার সংজ্ঞার্থ নির্ধারণ করতে গিয়ে উল্লেখ করেছে যে, যোগ্যতা হচ্ছে জ্ঞান, অনুধাবন, দক্ষতা এবং সক্ষমতার এক সমন্বয়। আবার ইংল্যান্ডে কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে যোগ্যতাকে কর্মসম্পাদন ও পেশাগত ভূমিকা পালনের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যোগ্যতা বলতে দক্ষতা, জ্ঞান ও ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যেমন : প্রবণতা, মনোভাব, আত্ম-ধারণা প্রভৃতিকে বোঝানো হয়েছে (Van der Klink and Boon, 2002)। অস্ট্রেলিয়ান শিক্ষাক্রমে যোগ্যতাকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘Capability’ হিসেবে। এই শিক্ষাক্রমে ধরে নেয়া হয়েছে জ্ঞান, দক্ষতা, আচরণ আর স্বভাব বা অন্তর্গত বিন্যাস (Dispositions)-এর সম্মিলনে গড়ে ওঠে যোগ্যতা। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে এবং বিদ্যালয়ের বাইরে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যখন জটিল ও পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কার্যকর ও যথার্থভাবে জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োগ করে তখন যোগ্যতা অর্জন করে। জার্মানিতে যোগ্যতাকে গ্রহণ করা হয়েছে প্রেক্ষাপট অনুযায়ী কোনো নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করার জন্য অর্জিত জ্ঞানমূলক ক্ষেত্রের পুনর্বিন্যাস করার সক্ষমতাকে। অন্যদিকে, এস্তোনিয়া তার শিক্ষাক্রমে যোগ্যতার সাধারণ ধারণাকে (অর্থাৎ জ্ঞান, দক্ষতা, মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি, এবং মূল্যবোধ-সংস্কৃতি) নিজস্ব প্রেক্ষাপট অনুযায়ী গ্রহণ করেছে (Estonia, 2014)।
ভিন্ন ভিন্ন ধারণায়নের মধ্যেও যোগ্যতা সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে, তা হলো, শিক্ষার্থী যদি কোন প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা ও মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, নৈতিকতা প্রভৃতির সন্নিবেশ ঘটিয়ে কর্মসম্পাদনে পারদর্শিতা প্রদর্শন করতে পারে তবে তাকে ঐ বিশেষ প্রেক্ষাপটে যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ বলা যায় (Kennedy D & Hyland A, 2009)। যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করার ক্ষেত্রে যে ধারণাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো নিজস্ব প্রেক্ষাপট বিবেচনা। কেননা শিক্ষার্থীদেরকে নিজস্ব প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সংযুক্ত করা না হলে তাদের মধ্যে যেকোনো যোগ্যতা গড়ে তোলাই দুরূহ হয়ে যেতে পারে (Klieme E. et al. 2008) ।
উপযুক্ত বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট যে, যোগ্যতার ধারণাসমূহের ভেতর কিছু উপাদান সার্বজনীন; যেমন : জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ প্রভৃতি, আবার কিছু উপাদান বিভিন্ন দেশ নিজস্ব প্রেক্ষাপট অনুযায়ী সংযুক্ত করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যোগ্যতাকে চারটি উপাদানের সমন্বয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সেগুলো হলো : মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, দক্ষতা ও জ্ঞান ।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে অভিযোজনের জন্য জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে অর্জিত সক্ষমতাকে এই শিক্ষাক্রম রূপরেখায় যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, বিবৃত উপাদানগুলোর আন্তঃসম্পর্ক সরলরৈখিক নয় বরং জটিল বহুমাত্রিক ।
যোগ্যতার সংজ্ঞা
উপরোক্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে যোগ্যতা হলো পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে অভিযোজনের জন্য জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বিত সক্ষমতা অর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্বত রাখা
যোগ্যতার ধারণার আলোকে তার উপাদানসমূহকেও সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যেন তা ভালোভাবে উপলব্ধি করে শিক্ষাক্রমের মূল যোগ্যতা, শিখনক্রম, শিখন-শেখানো কৌশল, শিখন-শেখানো সামগ্রী ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে প্রতিফলিত করা যায় ।
তথ্যসূত্র : শিক্ষাক্রম রুপরেখা-2021