(Coordination with technical and Vocational education and training stream)
দক্ষ জনশক্তি জাতীয় উন্নয়নের একটি অপরিহার্য উপাদান । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ফলে বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন কৌশল ও পদ্ধতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহন, উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ, দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত অসম ও প্রতিকুল প্রতিযোগিতার সম্মুখিন হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এ অসম প্রতিযোগিতায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে দ্রুত দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন। দেশের ভিতরে যেমন দক্ষ জনশক্তির চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই সাথে বিদেশেও দক্ষ জনশক্তির চাহিদা রয়েছে এবং ভবিষ্যতে এই চাহিদা আরো বাড়বে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অগ্রাধিকার বিবেচনায় একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে শিক্ষার্থীদের জীবন ও জীবিকার জন্য প্রস্তুত করতে সকল ধরনের শিক্ষা ধারায় মৌলিক (Foundational), রূপান্তরযোগ্য (Transferable) ও জীবিকা সংশ্লিষ্ট (Job Related) দক্ষতার অন্তর্ভুক্তি ও যথাযথ প্রতিফলন জরুরি। পাশাপাশি এক ধরনের সংগঠিত পথ-নির্দেশনাও প্রয়োজন যেন, যেকোনো ধারার শিক্ষার্থী তাদের অবস্থান, যোগ্যতা, দক্ষতা ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী পরস্পর পথ পরিবর্তন করে যথাযথ সহায়তা প্রাপ্তির মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ধারার শিক্ষার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। এ লক্ষ্যে সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা ধারায় ১ম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি বা সমমান পর্যন্ত সকল স্তর ও শ্রেণিতে সমন্বিত ও সুবিন্যস্তভাবে মৌলিক (Foundational) ও রূপান্তরযোগ্য (Transferable) দক্ষতার যথাযথ অন্তর্ভুক্তি ও প্রতিফলন করা হয়েছে।
বাংলাদেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষাকে জাতীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও চাহিদা বিবেচনায় যুগোপযোগী করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টিসহ শ্রমের মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষা নীতিতে বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। দেশ ও বিদেশের চাহিদা বিবেচনায় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দ্রুত জনশক্তি সৃষ্টি করা এবং দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের আয় বৃদ্ধি করার উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনাও শিক্ষানীতিতে বিবৃত হয়েছে। এ লক্ষ্যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম প্রণয়নসহ অন্যান্য শিক্ষাধারার সঙ্গে এর সমন্বয়ের বিষয়েও বিভিন্ন দিক নির্দেশনা রয়েছে। চাকুরি বাজারের বিকাশমান ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জনশক্তি তৈরি এবং ভবিষ্যৎ শ্রম-বাজারে (Job Market) টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার সংশ্লেষসহ এ ধারার শিক্ষার সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি, উচ্চ শিক্ষা ও চাকুরির সুযোগ সৃষ্টি এবং উদ্যোক্তা
তৈরির লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি ও বাংলাদেশ জাতীয় যোগ্যতা কাঠামো বিশ্লেষণে প্রাপ্ত শিক্ষাক্রম-সংশ্লিষ্ট নির্দেশনাসমূহ নিম্নরূপ :
- দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষার সকল ধারায় প্রাক- (ডিজিটাল প্রযুক্তি) প্রযুক্তি শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা; বৃত্তিমূলক এবং তথ্য ও যোগাযোগ
- অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা ধারায় ভর্তি হয়ে ধাপে ধাপে নির্বাচিত কারিগরি বিষয়ে উচ্চশিক্ষায় যাবার সুযোগ রাখা;
- সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষা ধারার যে কোনো স্তরে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নিয়ে অনুমোদিত কারিগরি ও বৃত্তিমূলক যোগ্যতা কাঠামো বা বাংলাদেশ জাতীয় যোগ্যতা কাঠামো অনুযায়ী নির্ধারিত অকুপেশনের প্রারম্ভিক লেভেলে জাতীয় দক্ষতা সনদ প্রাপ্তির সুযোগ রাখা, সেই সঙ্গে আরো প্রশিক্ষণ নিয়ে উচ্চতর লেভেলে সনদ অর্জন এবং কারিগরি ধারার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টি করা;
- কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ধারার নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি সমাপ্ত করে একজন শিক্ষার্থী বাংলাদেশ জাতীয় যোগ্যতা কাঠামো (বিএনকিউএফ) অনুযায়ী নির্ধারিত অকুপেশনের অনুমোদিত লেভেল অনুযায়ী জাতীয় দক্ষতা সনদ অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করা;
- প্রত্যেক শিক্ষা ধারায় মৌলিক বিষয় বাধ্যতামূলক এবং প্রতিটি ধারার স্বাতন্ত্র্য ও আদর্শ মান বজায় রেখে অন্যান্য বিষয় সংযুক্ত করা;
- মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কারিগরি শিক্ষা ধারার ট্রেডসমূহে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ জাতীয় যোগ্যতা কাঠামো অনুযায়ী অকুপেশন লেভেল নির্ধারণ করা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা সনদের পাশাপাশি জাতীয় দক্ষতা সনদ অর্জন তথা দ্বৈত সনদায়নের সুযোগ রাখা।
উপরোক্ত নির্দেশনা বিবেচনা করার পাশাপাশি ব্যানবেইস ২০১৯ রিপোর্ট পর্যলোচনা করলে দেখা যায় যে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি সম্পন্ন করার পূর্বেই প্রায় ৩৮% এবং দ্বাদশ শ্রেণি সম্পন্ন করার আগেই উচ্চমাধ্যমিক স্তরের প্রায় ২০% শিক্ষার্থী শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ঝরে যায়। এই শিক্ষার্থীর অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। আবার উচ্চ মাধ্যমিক সমাপ্ত করার পরও অনেক শিক্ষার্থী যারা উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশ করতে পারে না বা করেনা, তারাও একইভাবে কোনো রকম পেশাগত প্রশিক্ষণ বা দক্ষতা ছাড়াই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে।
এই পরিস্থিতি বিবেচনা করে, সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষা ধারায়, নবম-দশম শ্রেণিতে জীবন ও জীবিকা বিষয়ের আওতায় একটি বৃত্তিমূলক (অকুপেশনাল) কোর্স থাকবে, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের একটি নির্দিষ্ট বৃত্তির (অকুপেশনের) জন্য প্রস্তুত করা হবে। দশম শ্রেণি সমাপ্ত করার পর শিক্ষার্থীরা বৃত্তিমূলক (অকুপেশনাল) দক্ষতা বিষয়ক পেশায় সরাসরি যোগ দেওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করবে এবং প্রয়োজনে যোগ দিতে পারবে। বৃত্তিমূলক (অকুপেশনাল) কোর্সটি এমনভাবে ডিজাইন করা হবে যাতে শিক্ষার্থীদের বয়োসপোযোগী বর্তমান শ্রম বাজারের চাহিদা অনুযায়ী আত্মকর্মসংস্থানের বা কোনো চাকুরিতে যোগদানের মতো সক্ষমতা তৈরি হয়। জাতীয় শ্রম বাজারে সেবা, কৃষি ও শিল্প খাতের (৪০.৬১% : ৩৭.৭৫% : ২১.৬৫%) ১২ আনুপাতিক অবদান বিবেচনা করে বৃত্তি বা অকুপেশনগুলোর তালিকা প্রণয়ন করা হবে। স্থানীয় বা আঞ্চলিক অর্থনৈতিক খাত ও শ্রম বাজারের চাহিদা বিবেচনা করে বিভিন্ন অঞ্চলের বিদ্যালয়ের জন্য বৃত্তির (অকুপেশনের) ধরন নির্ধারণ করা হবে। পদ্ধতিগতভাবে নিয়মিত শ্রম বাজার জরিপ করে নতুন নতুন বৃত্তি (অকুপেশন) প্রণয়ন ও প্রবর্তন করা হবে।
উপরোক্ত নির্দেশনার প্রেক্ষিতে জাতীয় শিক্ষানীতি এবং জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিতে বর্ণিত কৌশল এবং জাতীয় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক যোগ্যতা কাঠামো বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এবং এ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে জাতীয় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক যোগ্যতা কাঠামোর স্তরসমূহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষায় বৃত্তিমূলক (অকুপেশনাল) কোর্স অন্তর্ভুক্তির একটি রূপরেখা নিম্নে দেখানো হলো । একই সঙ্গে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ধারার ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন ধারা থেকে পরস্পর পরিবর্তনের সুযোগ রেখে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের একটি পথ নির্দেশনা প্রদর্শিত হলো।
সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষা ধারায় ৬ষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে জীবন ও জীবিকা বিষয়ের সাথে একটি প্রি- ভোকেশনাল কোর্স অন্তর্ভুক্ত হলেও কারিগরি শিক্ষায় তা বর্ধিত কলেবরে হাতে কলমে অনুশীলনসহ থাকবে। সমতার রূপরেখা (Equivalency Framework) প্রণয়নের মাধ্যমে কারিগরি শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক আসা-যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।
উপরিউক্ত রূপরেখায় সংশ্লিষ্ট নীতিসমূহের নির্দেশনার প্রতিফলনসহ জাতীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও চাহিদা বিবেচনায় সুপারিশসমূহ নিম্নোক্তভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
১. সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষা ধারার ৮ম ও ১০ম শ্রেণি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের টিভিইটি ধারায় ভর্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
২. সাধারণ ও মাদ্রাসা ধারায় প্রি-ভোকেশনাল ও বৃত্তিমূলক (অকুপেশনাল) কোর্সসমূহ এমনভাবে বিন্যস্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যাতে এই ধারা দু’টিকেও টিভিইটি ইনক্লুসিভ শিক্ষা ধারা হিসেবে গণ্য করা যায়।
৩. কারিগরি শিক্ষা ধারার স্বাতন্ত্র্য ও নির্ধারিত কাঠামো অনুযায়ী দক্ষতার জাতীয় ও বৈশ্বিক মানদণ্ড অক্ষুণ্ণ
রেখে শিক্ষাক্রম রূপরেখায় সকলের জন্য অর্জন উপযোগী ১০টি যোগ্যতা অর্জনের উদ্দেশ্যে নির্ধারিত মৌলিক বিষয়সমূহ সমন্বয়ের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ রাখা হয়েছে। যা আন্তঃধারা ব্যবধান কমাতে সহায়তা করবে এবং যথাযথ সমতার রূপরেখার (Equivalency Framework) মাধ্যমে পারস্পরিক ধারা পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
৪. এসএসসি বা এসএসসি (ভোকেশনাল) বা সমমানের কোর্স সম্পন্ন করার পর ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হবার সুযোগ থাকবে।
৫. কারিগরি শিক্ষা ধারার কোর্সের কাঠামো ও ধারণায়ন (conceptualisation) অনুযায়ী ধারাবাহিক ও সামষ্টিক মূল্যায়নের অংশ হিসেবে প্রকল্পভিত্তিক, তাত্ত্বিক, ব্যবহারিক ও অন্যান্য উপায়ে মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে। কারিগরি শিক্ষা ধারায় নবম শ্রেণি শেষে শুধুমাত্র কারিগরি বিষয়ে পাবলিক পরীক্ষা হবে এবং দশম শ্রেণি শেষে সকল বিষয়ের পাবলিক পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি শেষে সকল বিষয়ে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
৬. শিক্ষাক্রম রূপরেখার ১০টি বিষয় ও কারিগরি ধারার কারিগরি বিষয়ের চাহিদা অনুযায়ী বিষয়সমূহের জন্য যৌক্তিকভাবে সময় বরাদ্দ করা হবে।
৭. টিভিইটি শিক্ষা ধারায় ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রি-ভোক বিষয়ের সাথে কর্মমূখী কারিগরি শিক্ষার প্রাথমিক ধারণা বিষয়ক একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে ।
তথ্যসূত্র : শিক্ষাক্রম রুপরেখা-2021