(Background of curriculum development)
মানুষ একটি পরিপূর্ণ জীবন প্রত্যাশা করে। সেই জীবন হবে নান্দনিক ও আনন্দময়। পাশাপাশি মানুষ পারিবারিক, সামাজিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নিজের অর্থপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করতে চায়। শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য জীবনকে নান্দনিক, আনন্দময়, ও অর্থবহ করে তোলা, এবং সেই সাথে শিক্ষার্থীকে জীবিকা অর্জনের উপযোগী যোগ্য, সৃষ্টিশীল ও মানবিক মানুষে পরিণত করা। একইসঙ্গে পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীকে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলাও শিক্ষার উদ্দেশ্য।
পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে মানুষের জীবন ও জীবিকা বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রযুক্তির উত্তোরোত্তর উৎকর্ষের কারণে পরিবর্তনের গতিও হয়েছে অনেক দ্রুত। দ্রুত পরিবর্তনশীল এই বিশ্বের সঙ্গে মানুষের অভিযোজনের কোনো বিকল্প নেই। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাত্রা পৃথিবীর ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে এগিয়ে চলেছে অভাবনীয় গতিতে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব পর্যায়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ মানুষের কর্মসংস্থান এবং জীবনযাপন প্রণালিতে যে পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে, তার মধ্য দিয়ে যন্ত্র ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক আরো নিবিড় হচ্ছে। এর ফলে বর্তমান সময়ের কর্মজগতের অনেক কিছুই ভবিষ্যতে যেমন থাকবে না, তেমনি অনেক নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে যা এই মুহূর্তে অনুমান করা প্রায় অসম্ভব । বিশ্বায়নের কারণে যেমন দেশে-দেশে, সমাজে-সমাজে ভৌগোলিক দূরত্ব ঘুচে যাচ্ছে, তেমনি আবার অবিমিশ্র নগরায়ণ, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্দেশিক অভিবাসন আমূল পাল্টে ফেলছে সনাতন জীবন ও সংস্কৃতি। পৃথিবী জুড়েই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটলেও যেমন তার সুষম বণ্টন হয়নি, তেমনি সামাজিক উন্নয়নও তাল মেলাতে পারছেনা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতির সঙ্গে । যার ফলে এখনও পৃথিবীতে রয়ে গেছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষার মত মৌলিক সমস্যাবলি। ঘনীভূত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, বায়ুদূষণ, অভিবাসন বা জাতিগত সহিংসতাজনিত সমস্যাসমূহ। দেখা দিচ্ছে কোভিড ১৯-এর মতো মহামারি যা সারা বিশ্বের জীবনযাত্রা এবং অর্থনীতিকে থমকে দিয়েছে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় সংযোজিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ এবং মাত্রা।
এসব চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তার টেকসই ও কার্যকর সমাধান এবং সম্ভাবনার পূর্ণ সুফল গ্রহণের জন্য জ্ঞান, দক্ষতা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন দূরদর্শী, সংবেদনশীল, অভিযোজন-সক্ষম, মানবিক এবং যোগ্য বিশ্ব-নাগরিক প্রড়িজন। একবিংশ শতাব্দীর তথ্য ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেরকম নাগরিক তৈরিতে হিমশিম খাচ্ছে সনাতনী শিক্ষাব্যবস্থা। কারণ এই সনাতন মুখস্থ ও পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল আজ থেকে তিনশত বছর আগের তৎকালীন সমাজের জীবন ও জীবিকার প্রয়োজন মেটানোর জন্য, এরপর শিক্ষা-কাঠামোর গুণগত পরিবর্তন হয়েছে খুব কমই। এখন প্রয়োজন এমন শিক্ষাব্যবস্থা, যা নমনীয়, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সক্ষম এবং উদ্ভূত আর্থসামাজিক প্রয়োজনের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন চলমান পুরোন সমস্যার টেকসই সমাধান, আর নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার চেষ্টা ও আত্মবিশ্বাস। এই সামগ্রিক বৈশ্বিক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পদার্পনের লক্ষমাত্রা অর্জনে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এই অভিলক্ষ্য পূরণের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার শিক্ষা। আর সেজন্য শিক্ষার আধুনিকায়ন অপরিহার্য। আর এই আধুনিকায়নের শুরুটা হতে হবে অবশ্যই একটি কার্যকর যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম উন্নয়নের মাধ্যমে যা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর একটি নিয়মিত এবং গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম । সর্বশেষ ২০১২ সালে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয় । সময়ের পরিক্রমায় পরিবর্তনশীল পৃথি বীর সাথে তাল মিলাতে নতুন শিক্ষাক্রম উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এই উদ্দেশ্যে শিক্ষার বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং শিখন চাহিদা নিরূপণের জন্য ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালব্যাপী বিভিন্ন গবেষণা এবং কারিগরি অনুশীলন পরিচালিত হয়। তারই উপর ভিত্তি করে প্রেক্ষাপট, প্রয়োজন এবং নতুন বিশ্বপরিস্থিতিতে টিকে থাকার মতো যোগ্য প্রজন্ম গড়ে তুলতে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণির অবিচ্ছিন্ন শিক্ষাক্রম উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।