নতুন শিক্ষাক্রম উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাঁচটি ভিত্তিকে বিবেচনা করা হয়েছে। সেগুলো হলো :
দার্শনিক ভিত্তি (Philosophical foundation)
মনোবৈজ্ঞানিক ভিত্তি (Psychological foundation)
ঐতিহাসিক ভিত্তি (Historic foundation)
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অগ্রাধিকার (Global and national priorities) এবং প্রমাণনির্ভর ভিত্তি (Evidence based Foundation)
দার্শনিক ভিত্তি (Philosophical foundation)
শিক্ষাক্রমের একটি দার্শনিক ভিত্তি থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত দার্শনিক ভিত্তিকে কেন্দ্র করে শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য প্রভৃতি নির্ধারিত হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক তত্ত বিশ্লেষণ করে সেগুলোর ভিত্তিতে নতুন শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য ও প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হয়েছে। যুগের পরিক্রমায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রথাগত অনেক দার্শনিক মতবাদ (যেমন- Perennialism, Essentialism, ইত্যাদি) প্রাসঙ্গিকতা হ্রাস পেয়েছে। বিভিন্ন তত্ত্বের মধ্যে প্রগতিবাদ (Progressivism) কে এই শিক্ষাক্রমে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এই মতবাদ অনুযায়ী শিক্ষাক্রমের মূল উদ্দেশ্য হলো দৈনন্দিন জীবন এবং সমস্যা নিয়ে শিক্ষার্থীর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গঠন এবং আগ্রহ সৃষ্টি করা। এই বিবেচনায় শিক্ষার্থীর শিখন হতে হবে আন্তঃবিষয়ক (interdisciplinary), সমন্বিত (integrative) এবং প্রক্রিয়া হবে মিথস্ক্রিয়ামূলক (integrative)। শিক্ষাবিজ্ঞানে সাম্প্রতিক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হল গঠনবাদ এবং পুনর্গঠনবাদ। গঠনবাদ অনুযায়ী শিখনের মূল উদ্দেশ্য হল পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে অভিযোজনের জন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করা। আর পুনর্গঠনবাদের ( Reconstructivism) দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী শিক্ষার্থী অভিযোজনের জন্য সামাজিক শিখন পরিবেশের সাথে প্রতিনিয়ত মিথষ্ক্রিয়া ঘটায় এবং এর ফলে শিক্ষার্থী ও শিখন পরিবেশ উভয়ের মাঝেই পরিবর্তন ঘটে। পরিবর্তনের এই অভিজ্ঞতাই শিক্ষার্থীর শিখনের ভিত্তি তৈরি করে। প্রগতিবাদ এবং পুনর্গঠনবাদকে মূল দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম রূপরেখার কাঠামো ও কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে এবং অন্যান্য মতবাদের প্রাসঙ্গিক ধারণাসমূহ প্রগতিবাদ এবং পুনর্গঠনবাদের আলোকে রূপান্তর ঘটিয়ে এই শিক্ষাক্রমে বিবেচনা করা হয়েছে।
মনোবৈজ্ঞানিক ভিত্তি (Psychological foundation )
শিক্ষাক্রমের মনোবৈজ্ঞানিক ভিত্তি শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ার ধরন কেমন হবে তার নির্দেশনা প্রদান করে। এই ভিত্তিটি তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের শিখন মতবাদের ধারণাসমূহ বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে। আচরণবাদী (Behaviourist) মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন শিখন একটি ধারাবাহিক পূর্ব নির্ধারিত প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ধাপে ধাপে শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে শিখন নিশ্চিত করতে হবে। অপর দিকে বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশ তত্ত্বের (Cognitive Development Theory) অনুসারী মনোবিজ্ঞানীগণ মনে করেন শিখন নির্ভর করে শিক্ষার্থীর তথ্য বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ার প্রতি মনোযোগ এবং চিন্তন প্রক্রিয়ার চর্চার ওপর । কাজেই এই মতবাদ অনুযায়ী শিখন-প্রক্রিয়া লুকিয়ে আছে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে একটি সমস্যা সমাধানমূলক চর্চার ওপর যা চিন্তন প্রক্রিয়াকে স্বজ্ঞাত, সৃষ্টিশীল এবং প্রতিফলনমূলক উপায়ে চর্চার মাধ্যমে অর্জিত হয়। অপরদিকে সামগ্রিকতাবাদে (Gestalt Theory) বিশ্বাসী মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন শিখন নির্ভর করে সমস্যাকে সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করে তা সমাধানের পথ বের করার ওপর, এই প্রক্রিয়ায় সমস্যার চারপাশের পরিবেশের উপাদান ও তার প্রভাব বিশ্লেষণ অতীব জরুরি একটি প্রক্রিয়া। কাজেই সামগ্রিকতাবাদ অনুযায়ী শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সমাজ ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন নিশ্চিত করতে পারলেই প্রকৃত শিখন ঘটে। এই সামগ্রিকতাবাদের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে সামাজিক গঠনবাদ (Social Constructivism) নামে একটি নতুন মনোবৈজ্ঞানিক ধারণার উদ্ভব ঘটেছে। এই মতবাদ শিক্ষার্থীর বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে সমস্যা সমাধানের জন্য উপযোগী পরিবেশ এবং পারস্পরিক যোগাযোগ তৈরির মাধ্যমে সৃষ্টিশীল সমাধান বের করার কৌশল নির্ধারণকে উৎসাহিত করে। পরিবেশ ও প্রতিবেশের সঙ্গে মানুষের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে যে সহাবস্থান তার ওপরে ভিত্তি করে মানুষের শিখন প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করে আরেকটি মতবাদ প্রবর্তিত হয়েছে, যা ব্রর্নফেনব্রেনারের
ইকলজিকাল সিস্টেম থিওরি (Ecological System Theory) নামে পরিচিত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে, ডিজিটাল টেকনোলজি প্রয়োগের ফলে মানুষের শিখনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিনির্ভর স্বাধীনতা (শিক্ষার্থীর প্রবণতা ও প্রেষণা অনুযায়ী শিখনের সময়, বিষয়বস্তু, শিখনের স্থান, উদ্দেশ্য ও শিখনের প্রক্রিয়াতে বহুমাত্রিক নমনীয়তা নিশ্চিত করা) এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ স্থাপন করার ভিত্তিতে এক নতুন শিখন ধারণার উদ্ভব ঘটেছে, যা সংযোগবাদ (Connectivism) নামে পরিচিত (Siemens, 2004)। এই শিক্ষাক্রম রূপরেখায় সামাজিক গঠনবাদ মতবাদ এবং এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা মতবাদসমূহকে মূল মনোবৈজ্ঞানিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, এবং এর সঙ্গে Howard Gardner (১৯৮৩)-এর বহুমুখী বুদ্ধিমত্তার তত্ত্ব (Multiple Intelligence Theory) যা সামাজিক গঠনবাদের ভিত্তির ওপরেই গড়ে উঠেছে; এবং যা ধারণা দেয় যে, মানুষের বুদ্ধিমত্তার বহুমুখী মাত্রা রয়েছে এবং একজন মানুষ এক বা একাধিক মাত্রার বুদ্ধিমত্তায় পারদর্শী হতে পারে, তাও এখানে বিবেচিত হয়েছে। সর্বোপরি এই রূপরেখায় প্রয়োজনভেদে অন্যান্য মতবাদেরও সীমিত ও যৌক্তিক চর্চা নিশ্চিত করা হয়েছে।
ঐতিহাসিক ভিত্তি (Historic foundation)
এ উপমহাদেশে প্রথম শিক্ষা কমিশন গড়ে উঠে ১৮৮২ সালে Sir William Wilson Hunter এর নেতৃত্বে যা হান্টার কমিশন নামে পরিচিতি লাভ করে। হান্টার কমিশন ১৮৮৩ সালে তার রিপোর্টে সর্বপ্রথম কোর্স এ (সাহিত্য) ও কোর্স বি (কারিগরি শিক্ষা) নামে দু’টি ধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রস্তাব করে। এর মাধ্যম ব্রিটিশ ভারতে সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে একই ধারার শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন হয় এবং ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তা বহাল থাকে । ১৯৪৯ সালে গঠিত মওলানা আকরাম খান শিক্ষা কমিটি’র রিপোর্ট অনুযায়ী যুক্তফ্রন্ট সরকার একটি সার্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক একই ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চেয়েছিল (Islam, S., 2012)। ১৯৫৭ সালে আতাউর রহমান শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশনও তার রিপোর্টে একই ধারার শিক্ষার কথা বলে। কিন্তু ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করার পর শরীফ খান শিক্ষা কমিশন গঠন করে এবং ১৯৫৯ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থায় নবম শ্রেণি থেকে সাধারণ শিক্ষাকে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা নামে তিনটি ধারায় বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় (Department of Education, Government of Pakistan, 1959)। আজ পর্যন্ত সেই ব্যবস্থাই প্রচলিত আছে। তবে স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সালে এই শিক্ষা কমিশন উদ্বোধন করেন । উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন যে, তিনি এমন একটি শিক্ষাকাঠামো চান যার মাধ্যমে একটি সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে যার ভিত্তি হবে সমতা । তাঁর দিক নির্দেশনা অনুযায়ীই এই কমিশন ১৯৭৪ সালে সার্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক একই ধারার সাধারণ শিক্ষার কথা সুপারিশ করেছিল (Government of the People’s Republic of Bangladesh, 1974) । এই শিক্ষাক্রম রূপরেখাটি ঐতিহাসিক এ প্রেক্ষাপট ও নির্দেশনাকে সামনে রেখে উন্নয়ন করা হয়েছে।
===000===
তথ্যসূত্র : শিক্ষাক্রম রুপরেখা-2021