ব্যক্তি তাঁর চারপাশের প্রকৃতি, পরিবেশ, সমাজ, সংস্কৃতির বাইরে পৃথক কোনো সত্তা নয় বরং এসব কিছুর মিথষ্ক্রিয়ায় গড়ে ওঠা একজন পরিপূর্ণ মানুষ । তাই শিক্ষার্থীর পরিপূর্ণ বিকাশে জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার পাশাপাশি কর্মজীবনের সঙ্গেও শিক্ষাকে সংগতিপূর্ণ করতে হবে। আমাদের প্রচলিত শিক্ষায় মাধ্যমিক স্তরের শেষ পর্যায় একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি । এই স্তরের শিক্ষার্থীর বয়স সাধারণত ১৬ থেকে ১৮ বছর। শিক্ষার্থীর জীবনে এই দুইটি বছর অন্তবর্তীকাল হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ এই পর্যায় শেষে শিক্ষার্থী স্নাতক বা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পায়, আবার একটি বড় অংশের শিক্ষার্থী কর্মজাতে প্রবেশ করে। তাই যারা স্নাতক স্তর কিংবা কর্মজগতে প্রবেশ করবে তাঁদের জন্য এ স্তরের শিক্ষাক্রম এমনভাবে বিন্যস্ত করা হবে যেন তাদের অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি উচ্চ শিক্ষা এবং ভবিষ্যত কর্মজাতের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়। পাশাপাশি পরিবর্তনশীল বিশ্বে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে যাতে সে ইতিবাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে সেই উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হবে।
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির বিষয় নির্ধারণ
এই স্তরকে বিশেষায়নের জন্য প্রস্তুতির স্তর হিসেবে বিবেচনা করা হয় । এই স্তরে অনেক শিক্ষার্থীকে যেমন উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয় আবার অনেক শিক্ষার্থীকে পরিস্থিতি বিবেচনায় কর্মজগতে প্রবেশের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়। পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে যেন সে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং ব্যক্তিক, সামাজিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যাতে সে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে সে উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে সকল শিক্ষার্থীর জন্য এই স্তরে আবশ্যিক একাধিক বিষয় থাকবে। প্রতিটি আবশ্যিক বিষয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষাক্রম রূপরেখায় চিহ্নিত এক বা একাধিক শিখন-ক্ষেত্রের প্রতিফলন থাকবে।
যেহেতু একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিখনের সার্বিক উদ্দেশ্য বিশেষায়নের জন্য প্রস্তুতি তাই নৈর্বাচনিক বিশেষায়িত বিষয়সমূহের জন্য এই স্তরে অধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। শিক্ষার্থী তাঁর আগ্রহ, সামর্থ্য ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনটি বিশেষায়িত বিষয় নির্বাচন করতে পারবে।
জীবন ও জীবিকা শিখন-ক্ষেত্রের আলোকে শিক্ষার্থীরা যেন আত্ম-কর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ হয় তার জন্য পেশাদারি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য প্রায়োগিক বিষয়সমূহ নির্বাচন করা যাবে। নির্বাচিত প্রায়োগিক বিষয়সমূহ থেকে ঐচ্ছিক হিসেবে যেকোনো একটি বিষয় নেয়া যাবে। এক্ষেত্রে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির জীবন ও জীবিকা বিষয়ে কর্মজীবনের পরিকল্পনা প্রণয়ন সংক্রান্ত বয়সোপযোগী যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যেন শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে তাদের আগ্রহ, ইচ্ছা, সক্ষমতা অনুযায়ী ভবিষ্যতের পরিকল্পনার মাধ্যমে বিষয় ও পথ নির্ধারণ করতে পারে ।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির বিষয় নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে সংক্ষেপে নিচে দেয়া হলো
আবশ্যিক বিষয় : একাধিক শিখন-ক্ষেত্রসমূহের ভিত্তিতে নির্ধারিত ৩টি বিষয় যা সকল শিক্ষার্থীর জন্য আবশ্যিক হবে।
নৈর্বাচনিক বিষয় : প্রচলিত সাধারণ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষার নৈর্বাচনিক, আবশ্যিক বিষয়সমূহ উন্মুক্ত রেখে বা প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে বিষয়গুচ্ছ নির্বাচন করা যেতে পারে। নির্বাচিত বিষয়গুচ্ছ থেকে একজন শিক্ষার্থীকে তার আগ্রহ ও ক্যারিয়ার পরিকল্পনা অনুযায়ী যেকোনো তিনটি বিষয় নির্বাচন করার সুযোগ দেয়া যেতে পারে ।
প্রায়োগিক বিষয় (ঐচ্ছিক) : পেশাদারি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য নির্ধারিত বিষয়সমূহ থেকে শিক্ষার্থীকে তার আগ্রহ ও ক্যারিয়ার পরিকল্পনা অনুযায়ী যেকোন একটি বিষয় বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া যেতে পারে।
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির আবশ্যিক, নৈর্বাচনিক এবং প্রায়োগিক বিষয়সমূহের প্রকৃতি ও বিন্যাস
একাদশ দ্বাদশ শ্রেণিতে মোট ভরের তিন চতুর্থাংশ বিশেষায়িত বিষয়সমূহের জন্য এবং এক চতুর্থাংশ ভর আবশ্যিক বিষয়সমূহের জন্য বরাদ্দ থাকবে। এই পর্যায়ে বিশেষায়িত বিষয়সমূহ যেহেতু বেশি প্রাধান্য পাবে, সেহেতু এ বিষয়সমূহের বিন্যাস এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে আবশ্যিক বিষয়সমূহের প্রকৃতি ও পরিসর নির্দিষ্ট করার পরে বিষয়ভিত্তিক শিখনযোগ্যতাসমূহ নির্ধারণ করা হবে। আবশ্যিক এক বা একাধিক বিষয়ে বিভিন্ন শিখন- ক্ষেত্রের সমন্বয় থাকতে পারে ।
আবশ্যিক বিষয়সমূহ কোন নির্দিষ্ট শিখনক্ষেত্রভিত্তিক না হয়ে বরং বিভিন্ন শিখন-ক্ষেত্রের নির্বাচিত শিখনযোগ্যতার সমন্বয়ে উন্নয়ন করা যেতে পারে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত নির্দিষ্ট শিখনক্ষেত্র বা বিষয়ের প্রাধান্য রেখে বিষয়সমূহ যেভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির বিষয়সমূহ তা না হয়ে বরং বৈচিত্র্যময় হবে বিধায় রূপরেখার বিষয় ও শ্রেণিভিত্তিক যোগ্যতার বিবরণী ও শিখনক্রমে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিখনযোগ্যতাসমূহ উল্লেখ করা হয়নি। তবে পরবর্তীতে এই বিষয়গুলোর শিখনক্রম বিন্যাসের সময় দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন শিখনক্ষেত্রের অর্জিতব্য শিখনযোগ্যতাসমূহের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।
নৈর্বাচনিক বিষয়ের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীকে তার আগ্রহ ও ক্যারিয়ার পরিকল্পনা অনুযায়ী যেকোনো তিনটি বিষয় নির্বাচন করার সুযোগ দেয়া হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির কোন একটি নৈর্বাচনিক বিষয়ের শিখনযোগ্যতা প্রণয়নের সময় দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন শিখনক্ষেত্রের অর্জিত শিখনযোগ্যতাসমূহ এবং ঐ বিষয়ের প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় যোগ্যতাসমুহ বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট নৈর্বাচনিক বিষয়ের গভীরতা ও পরিসর বিন্যাস করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের পুর্বজ্ঞানের সাথে যৌক্তিক সমন্বয় করতে পারে, একইসাথে পরবর্তী উচ্চশিক্ষার সাথেও সামঞ্জস্য বিধান হয়।
আবশ্যিক ও নৈর্বাচনিক বিষয়সমূহের বাইরেও একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে একটি প্রায়োগিক বিষয় ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে থাকবে। নির্ধারিত প্রায়োগিক বিষয়গুচ্ছ থেকে শিক্ষার্থী তার আগ্রহ ও ক্যারিয়ার পরিকল্পনা অনুযায়ী যেকোন একটি বিষয় বেছে নেয়ার সুযোগ পাবে। প্রায়োগিক বিষয়ের শিখনক্রম প্রণয়নের সময়ও দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন শিখন-ক্ষেত্রের, বিশেষ করে জীবন ও জীবিকার, অর্জিত শিখনযোগ্যতাসমূহ এবং ঐ বিষয়ে কর্ম উপযোগিতার জন্য নির্ধারিত দক্ষতার পাশাপাশি তথ্য-প্রযুক্তির সর্বশেষ অগ্রগতি এবং ভবিষ্যৎ কর্মজগতের চাহিদা ইত্যাদি বিবেচনায় বিষয়সমূহের পরিসর ও শিখনযোগ্যতা নির্ধারণ করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী একাদশ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম প্রচলন করতে বেশ কয়েক বছর সময়ের প্রয়োজন । সেই সময়ে বিষয়সমূহের একাডেমিক বাস্তবতা, স্থানীয় ও বৈশ্বিক চাহিদা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির সকল বিষয়সমূহের শিখনক্রম বিন্যাস করা হবে।
তথ্যসূত্র : শিক্ষাক্রম রুপরেখা-2021