মাদ্রাসা শিক্ষা এই উপমহাদেশের প্রাচীনতম একটি ধারা। আমাদের দেশে এটি তার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি স্বতন্ত্রধারা হিসেবে প্রচলিত। মাদ্রাসা শিক্ষার বিশেষত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখার মূলভিত্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখেই মাদ্রাসা শিক্ষাধারা সাজানো হয়েছে। সেই লক্ষ্যে মাদ্রাসা শিক্ষাধারার ক্ষেত্রে বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোই এই অধ্যায়ে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, সাধারণ শিক্ষাধারার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ দিকগুলোও মাদ্রাসার শিক্ষাক্রম উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
মাদ্রাসা শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও উন্নয়নের ভিত্তি
দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবী এবং বিশ্বায়নের যুগে সুযোগ এবং সম্ভাবনার যেমন সাধারণীকরণ হয়েছে, তেমনি সকলের সামনের চ্যালেঞ্জ ও বাধাগুলোর ধরনও এক। ন্যূনতম অবশ্য অর্জনীয় দক্ষতাসমূহ না থাকলে সেসব চ্যালেঞ্জ ও বাধা মোকাবিলা করা প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া পরিবর্তনের বহুমাত্রিকতার কারণেও প্রতিনিয়ত খাপ খাইয়ে চলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সকল ধারার শিক্ষার্থীদেরই ন্যূনতম সাধারণ (Common) কিছু যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। ফলে বিভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনা সাপেক্ষে বৈষম্য কমিয়ে এনে কতকগুলো অর্জনযোগ্য মূল যোগ্যতা সকলের জন্য নির্বাচন করা প্রয়োজন। এটি বিভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থাকে সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে একটি কাঠামোতে আনতে সহায়তা দিয়ে থাকে ।
যে কোনো উদ্যোগ তার পূর্ববর্তী প্রেক্ষাপটকে স্মরণ করে অগ্রবর্তী হয়। মাদ্রাসা ধারার শিক্ষাব্যবস্থাও তার ব্যতিক্রম নয়। এর একটি সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যপূর্ণ গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। মাদ্রাসা মুসলিম উম্মার বুনিয়াদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যুগ যুগ ধরে পরিগণিত হয়ে আসছে। এর কারণ হলো, ইহলৌকিক এবং পারলৌকিক সফলতার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা সর্বদা সচেষ্ট ছিল।
বস্তুতঃ ইসলাম ধর্মের উন্মেষ কালেই মাদ্রাসা শিক্ষার সূচনা ঘটে । হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) (uads lb (do ৩) হিজরতের পূর্বে মক্কার অদূরে অবস্থিত সাফা পাহাড়ের পাদদেশে ‘দারুল আরকাম’ এবং হিজরতের পর মসজিদে নববীর উত্তর-পূর্ব দিকে ‘সুফফা আবাসিক মাদ্রাসা’ ও ‘দারুল কুররা মাদ্রাসা’ স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে হযরত ওমর (রা.) সিরিয়ায় ও হযরত আলী (রা.) বসরা ও কুফায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। খোলাফায়ে রাশেদার সময়ে ইসলামী সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ৪০টিরও অধিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলাম ধর্মের প্রসারের ধারাবাহিকতায় ৭১২ সালে মুহাম্মদ বিন কাসেমের সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে উপমহাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার বিস্তার ঘটে।
১২০৪ সালে মুসলমানদের বঙ্গ বিজয় ও শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে বাংলায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়। সুলতানী শাসনামলে (১২১০-১৫৭৬ খ্রিঃ) বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্যসূচিতে কুরআন, হাদিস, ফিকহ, আরবি, নাহু, সরফ, বালাগাত, মানতিক, কালাম, তাসাউফ, হিকমত ও দর্শন অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তীকালে মাদ্রাসা শিক্ষাক্রম বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পরিমার্জিত ও আধুনিকীকরণ হয়। বিশেষভাবে মুঘল আমলে মাদ্রাসা শিক্ষাক্রমে ইসলামি বিভিন্ন বিষয়াদির সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা পর্যায়ক্রমে যুক্ত হয়। এগুলোর মধ্যে চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, ভূগোল, হিসাববিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান, লোক প্রশাসন, জীববিদ্যা, পদার্থ, রসায়ন ও প্রাণিবিদ্যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ভারত উপমহাদেশের উলামায়ে কেরাম ও সাধারণ মুসলমানদের সম্মিলিত দাবীর প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ শাসনের প্রথমদিকে দীর্ঘকাল সরকারি কাজে, বিশেষ করে দলিল-দস্তাবেজ ও আদালতের ভাষা ফার্সি থাকায় মাদ্রাসা শিক্ষা প্রায়োগিক গুরুত্ব লাভ করে। সে সময় মোল্লা মাজদুদ্দীন (মোল্লা মা’দান) রহ. এর নেতৃত্বে ‘কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে তা ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদন লাভ করে । পরবর্তী কালে বাংলার বিভিন্ন স্থানে ‘কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা’র অনুসরণে নতুন নতুন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, কলকাতা মাদ্রাসা ধারার বাইরেও বাংলায় বিভিন্ন ধারার মাদ্রাসা চালু ছিল। ব্রিটিশ সরকারের ১৯০৬ সালে গঠিত ‘মাদ্রাসা রিফোর্স কমিটি’ কর্তৃক ১৯১৪ সালে ‘রিফোর্সড মাদ্রাসা স্কীম’ নামে মাদ্রাসা শিক্ষাক্রমকে আধুনিকায়ন করার চেষ্টা করে এবং তা ফলপ্রসূ হয়। এখানে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাকে আবশ্যিক করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিলো মক্তব এবং মাদ্রাসাগুলোকে আধুনিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মতো উন্নত মাত্রায় নিয়ে যাওয়া। এপ্রিল ১৯১৫ তে এটি কার্যকর হয়। মাদ্রাসা শিক্ষাক্রমের এই পরিমার্জন অধিকাংশরাই মেনে নিয়েছিলেন – যা ‘নিউ স্কীম’ নামে পরিচিত। অল্প কিছু সংখ্যক মাদ্রাসা তাদের পুরনো ধারাতেই আবদ্ধ ছিল। এ সকল মাদ্রাসার মধ্যে অন্যতম কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা যা ওল্ড স্কীমের আওতাভুক্ত ছিল।
১৯৭৩ সালের ৩০শে মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকার মাঠে ভাষণে প্রদত্ত নির্দেশনার মাধমে মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে নতুনভাবে গতি সঞ্চার হয় ।
১৯৮৪ সালে ‘মুস্তফা বিন কাসিম কমিটি’র সুপারিশের আলোকে বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষা স্তরের সাথে সামঞ্জস্য বিধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাকে কয়েকটি স্তরে বিভক্ত করা হয়। এভাবে বর্তমানে বাংলাদেশে সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে সামঞ্জস্য গড়ে উঠেছে। ফলে বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষার সমমান পাচ্ছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার জন্য কিছু সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেছে। ইসলাম শিক্ষার সুযোগ তৈরির পাশাপাশি জীবনধারণ-সংক্রান্ত শিক্ষা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী হয়ে শিক্ষার্থীরা যেন উৎকর্ষে ভূমিকা রাখতে পারে সে ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মাদ্রাসা শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের পূর্ববর্তী সকল গবেষণা থেকে শিক্ষার্থীর উৎকর্ষ সাধনকল্পে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা পাওয়া গিয়েছে যা সাধারণ শিক্ষাধারার সাথে মাদ্রাসার শিক্ষাধারার সমন্বয়কে অনুপ্রাণিত করে।
জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ২০১১ সালে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। ২০১৫ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়।
২.১৯.২ বিশেষায়িত ধর্মীয় শিক্ষাধারা হিসেবে রূপরেখায় উল্লিখিত রূপকল্প অর্জনের পাশাপাশি ইসলামি মূল্যবোধে সমৃদ্ধ তাকওয়াবান যোগ্য আলিম তৈরি করাও মাদ্রাসা শিক্ষাধারার অন্যতম উদ্দেশ্য।
২.১৯.৩ মাদ্রাসা শিক্ষাধারার ক্ষেত্রে শিক্ষাক্রমের রূপকল্প বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত অভিলক্ষ্যসমূহের সাথে মাদ্রাসাকে ইসলামি আকিদা, আমল, আখলাক ও ইলম চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। ২.১৯.৪ মাদ্রাসা শিক্ষাধারায় শিক্ষার্থীকে বিশ্বপরিস্থিতিতে টিকে থাকার মতো যোগ্য, তাকওয়াবান ও আধুনিক মানসিকতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে এবতেদায়ী থেকে আলিম শ্রেণি পর্যন্ত একটি অবিচ্ছিন্ন শিক্ষাক্রম উন্নয়নের উদ্যোগ জরুরি। এবতেদায়ী ও দাখিল-আলিম পর্যায়ের শিক্ষা সম্পন্ন করে একজন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণ করবে বা কর্মজীবনে প্রবেশ করবে।
২.১৯.৫ শিক্ষাক্রম রূপরেখায় বর্ণিত সংহতি, দেশপ্রেম, সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধা/সম্মান ও শুদ্ধাচার এই মূল্যবোধগুলোর পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষাধারার ক্ষেত্রে ইসলামি মূল্যবোধকে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই শিক্ষাধারা ইমান, আকিদা, আমল এবং আখলাক এর মধ্য দিয়ে ইসলামি মূল্যবোধকে ধারণ করে।
২.১৯.৬ শিক্ষাক্রম রূপরেখায় উল্লিখিত শিক্ষার্থীর কাক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মাদ্রাসা শিক্ষাধারায় যুক্ত হবে তাকওয়া। তাকওয়া বলতে আল্লাহর ভয় ও পরকালীন জবাবদিহিতাকে সামনে রেখে সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ জীবন যাপনকে বুঝানো হয়। ফলে একজন শিক্ষার্থী নিজ সম্প্রদায়সহ অন্যান্য সকল সম্প্রদায়ের মানুষের বিশ্বাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতি সম্প্রীতি সংস্থাপন করতে উদ্যোগী হয়ে উঠবে।
২.১৯.৭ শিক্ষাক্রম রূপরেখায় শিক্ষার্থীর যেসব দক্ষতা নির্ধারণ করা হয়েছে তা মাদ্রাসা শিক্ষাধারায় সমভাবে
প্রযোজ্য।
২.১৯.৮ মাদ্রাসা শিক্ষাধারায় যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা এবতেদায়ি থেকে আলিম
স্তর পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষাক্রমে বর্ণিত দশটি মূল যোগ্যতা অর্জন করবে। স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য এই শিক্ষাধারা জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখায় বর্ণিত ‘ধর্মীয় অনুশাসন, সততা ও নৈতিক গুণাবলী অর্জন এবং শুদ্ধাচার অনুশীলনের মাধ্যমে প্রকৃতি ও মানব-কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারবে ’- যোগ্যতাটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ইসলাম শিক্ষা শিখনক্ষেত্র হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। ইসলাম শিক্ষা শিখনক্ষেত্র অনুযায়ী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্বতা ও সৃষ্টিকর্তা সম্বন্ধে সঠিক উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। যেমন : স্রষ্টা ব্যতীত সৃষ্টির অস্তিত্ব কল্পনাতীত হওয়ার উপলব্ধি। সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে কুরআন, সুন্নাহ ও ফিকহের জ্ঞান প্রয়োগ করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসনের নিয়মিত চর্চা ও কুরআন মাজিদ তেলাওয়াতে দক্ষ হতে হবে। সর্বোপরি, আলাহ তা’য়ালার প্রতি সঠিক ও সুদৃঢ় বিশ্বাস রেখে জীবনের প্রতিটি কাজে তাঁর আদেশ নিষেধকে প্রাধান্য দেয়ার মাধ্যমে মহান আল্লাহ তা’য়ালার প্রতি আত্মনিবেদন দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
২.১৯.৯ স্বাতন্ত্র্য ও গুরুত্বের বিবেচনায় মাদ্রাসা শিক্ষাধারার জন্য এবতেদায়ী থেকে দাখিল স্তর পর্যন্ত বিষয়সমূহের সমন্বয়ভিত্তিক যৌক্তিক বিন্যাস গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে।
২.১৯.১০ বিস্তারিত শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সময় মাদ্রাসা শিক্ষার বিশেষায়িত বিষয়সমূহ চূড়ান্ত করা হবে
এবং তার শিখন-শেখানো সামগ্রী উন্নয়ন, শিখন-শেখানো কৌশল ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হবে। মাদ্রাসা শিক্ষার বিশেষায়িত বিষয়সমূহে এবতেদায়ী থেকে দাখিল ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত নিম্নবর্ণিত ৫টি আবশ্যিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে-
১. কুরআন মাজিদ ও তাজবিদ; ২. হাদীস শরিফ; ৩. আরবি; ৪. আকাইদ ও ফিকহ এবং ৫. ইসলামের ইতিহাস
২.১৯.১১ মাদ্রাসা শিক্ষাক্রম পরিমার্জন
মাদ্রাসা শিক্ষার বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যৎ স্বরূপ সংক্রান্ত বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড এবং এনসিটিবির গবেষণার ফলাফলে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের প্রত্যাশা প্রতিফলিত হয়েছে। গবেষণায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট, লক্ষ্য ও অগ্রাধিকার বিবেচনায় মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার সুপারিশের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশপ্রেম, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সৃষ্টি এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের সুযোগ সৃষ্টির প্রতিও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে অন্যান্য শিক্ষা ধারার সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষার বৈষম্য কমিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষায় যুগের চাহিদা ও ভবিষ্যৎ কর্মজগতের জন্য প্রস্তুতির উপর জোর দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যেন স্বাস্থ্য সচেতনতা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, ডিজিটাল প্রযুক্তিসহ সামাজিক বা অন্যান্য ক্ষেত্রে পিছিয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ গ্রহণের সুপারিশ গবেষণায় উঠে এসেছে। শ্রেণি-কার্যক্রমকে আনন্দদায়ক, বহুমুখী ও কার্যক্রমনির্ভর করে দক্ষতা ও যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়ন চালুর সুপারিশের পাশাপাশি শিক্ষার্থীর যথাযথ শিখন অর্জনে গঠনকালীন মূল্যায়ন প্রয়োজন বলেও অংশীজনরা মতামত দিয়েছেন। যৌক্তিকতা, নীতি-নির্দেশনা, ঐতিহাসিক পটভূমি এবং সর্বোপরি অংশীজনদের মতামত বিশ্লেষণে মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে সমন্বিত ও সর্বজন প্রত্যাশাসমূহ নিম্নরূপ :
- সকল শিক্ষার্থীর জন্য বর্ণিত ১০টি মূল যোগ্যতা অর্জনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা;
- সাধারণ বা অন্যান্য শিক্ষাধারার সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষার বিদ্যমান বৈষম্য (বিষয়, বিষয়বস্তু, নম্বর, সময়, ভর ইত্যাদি) কমিয়ে এনে যুগোপযোগীকরণের মাধ্যমে অন্যান্য ধারার সঙ্গে সমযোগ্যতা ও সমগ্রহণযোগ্যতা যেন নিশ্চিত হয় সে লক্ষ্যে পরিমার্জনের উদ্যোগ গ্রহণ করা;
- মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশপ্রেম, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের বিষয়টি নিশ্চিতকরণ;
- পরিবর্তনশীল কর্মবাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা;
- শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সার্বিকভাবে সুস্থ ও ভালো থাকার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করা;
- শিল্প, সংস্কৃতি, খেলাধুলা ইত্যাদি ধর্মীয় নীতি নির্দেশনা ও ভাব গাম্ভীর্য বজায় রেখে সংযুক্ত ও চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করা;
- স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে সাধারণ শিক্ষায় প্রস্তাবিত ১ম থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত মৌলিক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির জন্য অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও বিষয় চালুর প্রায়োগিক ধারণাটি বিবেচনা করা;
- ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল সমন্বয়ের মাধ্যমে শিখন-শেখানো কার্যক্রম আনন্দদায়ক, অংশগ্রহণমূলক, অভিজ্ঞতাভিত্তিক এবং বহুমুখী করা;
- যোগ্যতা ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়নের পাশাপাশি শিখনকালীন ধারাবাহিক মূল্যায়নকে গুরুত্ব প্রদান করে দক্ষতা ও যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়ন চালু করা;
- ধর্মীয় শিক্ষার গভীরতা ও ব্যাপ্তি বৃদ্ধি ও শক্তিশালীকরণ;
- শিক্ষাক্রম রূপরেখায় বর্ণিত মূল্যবোধ, গুণাবলি, দক্ষতা, যোগ্যতা ও মূলনীতি অনুসরণ করে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা ।
উপর্যুক্ত প্রত্যাশা, মতামত এবং সর্বজনগ্রাহ্য পরামর্শের সফল প্রতিফলনে মাদ্রাসা শিক্ষাক্রম পরিমার্জনে নিম্নবর্ণিত কৌশলসমূহ অবলম্বন করা হবে :
- ১০টি মূল যোগ্যতা অর্জনকে প্রাধান্য দিয়ে বিষয়নির্ভরতা কমিয়ে যোগ্যতা ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্ৰণয়ন;
- যে বিষয়বস্তুসমূহ নিশ্চিতভাবেই থাকতে হবে তা নির্ধারণ করে নিজস্বতা/স্বকীয়তা বজায় রেখে পরিমার্জন করা;
- প্রযোজ্য ক্ষেত্রে মুখস্থনির্ভরতা কমিয়ে যোগ্যতাভিত্তিক অভিগমনে (Approach) কার্য ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন পদ্ধতির মাধ্যমে শ্রেণিকার্যক্রম পরিচালনা করে বিষয় এবং বিষয়বস্তুর ভার কমানো;
- ধারার স্বকীয়তা বজায় রেখে সমন্বিত প্রক্রিয়ায় আন্তঃবিষয় এবং আন্তঃশাখাভিত্তিক কৌশল প্রয়োগ করে বিষয় এবং বিষয়বস্তুর ভার, সময়, নম্বর ইত্যাদির বৈষম্য কমিয়ে আনা;
- নীতি-নির্দেশনা ও গবেষণা থেকে প্রাপ্ত সুপারিশসমূহ পর্যালোচনা এবং রূপরেখার মৌলিক নির্দেশনাসমূহ অনুসরণে কারিগরি অনুশীলনের মাধ্যমে শিখন-ক্ষেত্র ও বিষয়-সংক্রান্ত পদ্ধতিগত বৈষম্য কমিয়ে আনা;
- অবশ্য গ্রহণীয় বিষয়সমূহ অগ্রাধিকারভিত্তিতে চিহ্নিত করে সমন্বয়ের মাধ্যমে বিদ্যমান বৈষম্য কমানো
- শিক্ষার্থী যেন অন্য যে কোনো ধারায় শিক্ষার সমান সুযোগ পায় তার ব্যবস্থা রাখা;
- বিষয়, বিষয়বস্তুর প্রাধান্য কমিয়ে যোগ্যতা ও দক্ষতাকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা;
শিক্ষা-কার্যক্রম শেষে একজন শিক্ষার্থীর কাছে যে প্রত্যাশা থাকে তা যথাযথভাবে অর্জন হচ্ছে কিনা সে বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পরিমার্জন কার্যক্রম পরিচালনা করলে বিষয়বস্তুর ভার অনেকাংশে কমানো সম্ভব। শিক্ষার্থীকে অনেক বেশি বিষয়বস্তু না দিয়ে কীভাবে অন্বেষণ বা অনুসন্ধান করে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে যোগ্যতা অর্জন করতে হয় তা শেখানো গেলেই জীবনব্যাপী শিখনের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়া সম্ভব।
তথ্যসূত্র : শিক্ষাক্রম রুপরেখা-2021
===000===